কিভাবে যাওয়া যায়:
সিএনজি, বাস, অটো-রিক্সা, রিক্সা ইত্যাদি যানবাহন যোগে তালজাঙ্গা যাওয়া যায়। তাড়াইল সদর থেকে প্রায় ৯.০০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত তালজাঙ্গা জমিদার বাড়ী।
তালজাংগা জমিদারবাড়ীঃ
তাড়াইল উপজেলা সদর থেকে প্রায় ০৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে তালজাংগা ইউনিয়নে এ জমিদারবাড়ী অবস্থিত। বাবু রাজ চন্দ্ররায় এই জমিদারীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি একজন এম, এ,বি এল ডিগ্রীধারী অভিজ্ঞ উকিল ছিলেন। তাঁর আমলেই ১৯১৪ খ্রিঃ নির্মিত হয় বাস ভবন, প্রশাসনিক প্রাসাদ, কালীমন্দির, শিবমন্দির শান বাধানো তিনটি পুকুর। এছাড়া ময়মনসিংহে তার পরিত্যক্ত বাড়ীতে বর্তমানে আলমগীর মনসুর মেমোরিয়াল মিন্টু কলেজটি স্থাপিত এবং কিশোরগঞ্জ শহরে তার বাসভবনে বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের কার্যালয় অবস্থিত।
বাসভবন
১৯১৪ সালে দোতলা বাসভবনটি নির্মাণ করা হয়। উপর তলায় বসবাসের জন্য ৬টি কক্ষ ছিল। হাম্মাখানা ও শৌচাগার এবং উপর তলায় উত্তর পার্শ্বে অন্ধ কূপ। তাছাড়া উপরের তলায় কক্ষের উপরিভাগে ছিল টাকা পয়সা, সোনাদানা রাখার জন্য একটি গুপ্ত কক্ষ, যা সহজে পরিলক্ষিত হয় না। বাস ভবনের উপর তলার প্রত্যেক দরজার সামনের রেলিংগুলি ভেঙ্গে যাওয়ায় এর সৌন্দর্য্যের শোভা হারিয়ে গেছে। বিশাল এ প্রাসাদটিতে বিলাসিতার চিত্র ফুটে আছে। উপর তলায় ছিল অন্তপুরের নারীদের জন্য রক্ষিত। নীচ তলায় দক্ষিণ পার্শ্বের কক্ষটি প্রশাসনিক কাজের জন্য কাচারী হিসাবে ব্যবহৃত হত। নীচ তলায় উত্তর পার্শ্বের কক্ষটি বিশ্রামাগার হিসাবে ব্যবহৃত হত এবং উত্তর পূর্ব পার্শ্বে কক্ষটি পূজারীদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। তা বর্তমানে পোস্ট অফিস হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। উপর ও নীচে প্রাসাদের অনেক দরজা জানালা নেই এবং প্রাসাদের বিভিন্ন স্থানের প্লাস্টার উঠে যাওয়ার ফলে এর কারুকার্যের সেৌন্দর্য্য হারিয়ে যেতে বসেছে।
কালীবাড়ী মন্দির
বাসভবনের উত্তর পার্শ্বে জয়কালী মন্দির অবস্থিত। এর নির্দিষ্ট আংগিনায় বেষ্টনী দেয়া আছে। বিভিন্ন পূজাপার্বনে হিন্দুরা ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে থাকে।
নাট্যশালা
কালীমন্দিরের পূর্বদিকে বিশাল আকৃতির চেৌচালা টিনের নাট্যমন্দির ছিল বলে জানা যায়। যেখানে বিভিন্ন পূজা পার্বনের সময়ে যাত্রা, নাটক অনুষ্ঠিত হত। তাছাড়াও বাৎসরিক কীর্তন এর আসর জমত। অযত্ন ও অবহেলার কারণে এই নাট্যমন্দিরটি ভেঙ্গে যায়। অকেজো টিনের ঘরটি এস্থান থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। বর্তমানে সে স্থানে স্কুল ঘর উঠেছে।
শিবমন্দির
পুকুরের পূর্বপাশে শিবমন্দিরটি অবস্থিত। শিব মন্দিরটি এখনও অক্ষত অবস্থায় এর ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। শিব মন্দিরের পশ্চিম পার্শ্বে জমি দখল করে দোকানপাট গড়ে তোলার ফলে এর পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সংকুচিত হয়েছে এবং সৌন্দর্য্য হারিয়েছে। তবে এখনও সারা বৎসর হিন্দু সম্প্রদায় শিবের পূজা করে আসছে।
হাতিশালা
জমিদার রাজচন্দ্র রায়ের অনেকগুলি হাতী ছিল বলে জনা যায়। পুকুরের দক্ষিণ পার্শ্বে হাতী রাখার জন্য শিকল পোঁতা্ ছিল। বর্তমানে রাস্তার উন্নয়নের সময় মাটির নীচে শিকলগুলি চাপা পড়ে যায়। কথিত আছে যে, হাতীর খাবারের জন্য আলাদা জমি নির্ধারিত ছিল। বর্তমানে তালজাঙ্গা হতে হাতী চড়ে ময়মনসিংহে যাতায়াত করত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেকগুলো হাতী বৃটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে নেয় যুদ্ধের অস্ত্রযোগান দেয়ার জন্য।
পুকুর
জমিদার বাড়ীতে মোট ৩ টি পুকুর বিদ্যমান রয়েছে যার চারিদিকেরই শানবাধানো ঘাট রয়েছে। বাড়ীর পিছন দিকে রয়েছে মহিলাদের ব্যবহারের জন্য শানবাধানো পুকুর এবং বাড়ীর সামনের পুকুরটি জমিদার নিজে ব্যবহার করতেন বলে এর চারিদিকের শানবাধানো ঘাটের কারুকার্য ছিল আলাদা। এই পুকুর প্রাজারা ব্যবহার করতে পারতোনা। বাড়ীর উত্তর পার্শ্বে বর্তমানে ইউনিয়ন ভূমি অফিস অবস্থিত। জমিদারের বাস ভবন সংলগ্ন কাচারীটি পরিবর্তন করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। বর্তমান কাচারীর সামনে পুকুরটি প্রজাদের পানীয় জলের সুবিধার জন্য খনন করে এবং এর চারিদিকে সাধারণ ভাবে শানবাধানো ঘাট নির্মাণ করে দেয়া হয়। কাচারীর পুকুরেই হাতীদের গোসল করানো হতো বলে এই ভূমি অফিসের নৈশ প্রহরী জানায়। বর্তমান কাচারীর দক্ষিণ ও পূর্বপার্শ্বে ছিল পারিবারিক শ্মশান।
দাতব্য চিকিৎসালয়
কাচারী পুকুরের উত্তর পার্শ্বে প্রজাদের চিকিৎসার জন্য জমিদার রাজ চন্দ্র রায় এর নামে দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করা হয়। নিজ খরচে ডাক্তার রাখা হত এবং ঔষধ পত্র বিনামূল্যে রোগীদের দেয়া হত। বহুদিন পর্যন্ত এ চিকিৎসালয়টি চালু ছিল। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। এর পার্শ্বে সরকারীভাবে পরিবার পরিকল্পনা উপ-স্থাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।
অন্ধকূপ
প্রাসাদের উপর তলার পশ্চিম উত্তর কোণায় একূপটি বিদ্যমান। সরু অন্ধকার কক্ষটির একটি মাত্র দরজা। হাত-পা বেধে রাতভর কূপে আটকিয়ে রাখা হত বিদ্রোহী প্রজাদের শাস্তি দেয়ার জন্য।
স্মৃতিসৌধ
পুকুরের পূর্বপার্শ্বে শিব মন্দিরের দক্ষিণ দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে জমিদার রাজচন্দ্র রায়ের স্মৃতিসৌধ। সুউচ্চ বিশাল এখনও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। মঠের উপরে ছোট বড় সাজানো তিনটি কলসীর উপরে ত্রিশালটি পূর্বদিকে হেলে পড়েছে। মঠের নিচের মূল কক্ষটির চারটি স্তম্ভের এবং দেয়ালের অনেকগুলো ইট খসে পড়েছে এবং কোন দরজা জানালা নেই। অরক্ষিত থাকায় মূল্যবান কাঠের দরজা জানালা চুরি হয়ে গেছে। স্মৃতিসৌধের ফলকের উপর লেখনী থেকে জানা যায় জমিদার রাজচন্দ্র রায় বাংলা ১২৫০ সন ১৮ই ভাদ্র জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৩২১ সনে ২রা শ্রাবণ ধরাধাম ত্যাগ করেন।
জমিদার মুত্যুর পর তার সুযো্গ্য ছেলে মহিমচন্দ্র রায় পিতার স্থলাভিষিক্ত হন এবং দক্ষ ও বিচক্ষণ জমিদার হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি কলিকাতা থেকে এম,এ,বি,এল ডিগ্রীলাভ করে ময়মনসিংহে জজ কোর্টের উকিল হিসাবে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি একজন অভিজ্ঞ আইনজীবী ছিলেন এবং ময়মনসিংহ উকিলবারের সভাপতি ছিলেন। তালজাঙ্গা মাইজখাপন ও দামিহা ইত্যাদি স্থানে কাচারী স্থাপন করেন।
তিনি একজন প্রজা হিতৈষী, বিচক্ষণ, শিক্ষানুরাগী ও ধর্মানুরাগী জমিদার ছিলেন। প্রজাদের চিকিৎসার জন্য দাতব্য চিকিৎসালয়ত, ধমীয় কাজের জন্য কালী মন্দির, শিবমন্দির এবং প্রজাদের পানীয় জলের জন্য বহু দীঘি খনন করেন। তিনি একজন বর্ণবাদী জমিদারও ছিলেন।
মহিমচন্দ্র রায়ের ৫জন পুত্র যথাক্রমে, রাজেন্দ্র চন্দ্র রায়, রবীন্দ্র চন্দ্র রায়, রঞ্জন চন্দ্র রায় ও সুধীর চন্দ্র রায়। এ জমিদারীর শেষ নায়েব ছিল প্রফুল্ল কুমার রায়। ১৯৫০ সনের জমিদারী অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ত্ব আইন বালে সরকার বাহাদুর উক্ত জমিদারী অঘিগ্রহণ করে নেয়। জমিদারী চলে যাওয়ার পর তার পরিবার পরিজন নিয়ে ভারতে চলে যান। জমিদার বাড়ীটি আর,সি, রায় উচ্চ বিদ্যালয়ের নামে দান করে যান।
বর্তমানে জমিদার বাড়ীর ঐতিহ্যবাহী প্রাসাদগুলি অযত্ন ও অবহেলার কারণে ধ্বংস হতে চলেছে। সরকার কর্তৃক সংরক্ষণ করে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ দ্বারা সংস্কার করে ও অবৈধ দখলদারদের নিকট থেকে জমি উদ্ধার করে দর্শকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলে এখানে একটি পর্যটন কেন্দ্র স্থাপিত হতে পারে। এতে তাড়াইলের ঐতিহ্যের স্মৃতি ভাস্বর হয়ে থাকবে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস